অগ্নি-পাটের শাড়ি কন্যা, যখন নাকি পরে
স্বর্গের তারা লজ্জা পায়, দেখিয়া কন্যারে।
–দ্বিজ ঈশান।
ঈদের দিন সকালে মুনিয়া নতুন শাড়ির ভাঁজ খুলবে। সকালে গোসল সেরে গায়ে জড়িয়ে নেবে পছন্দের টাঙ্গাইল শাড়িটি। সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ। আর তাই তো রোজা শুরুর আগেই বাজার ঘুরে ঘুরে কিনে ফেলেছে পছন্দের তিনটি শাড়ি। বিকেলে বা রাতে আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াত খেতে গেলে পরবে দেশীয় কাতান। আর বেনারসি শাড়িটি ন্যাপথলিন দিয়ে যত্ন করে রেখে দেবে ভিন্ন কোনো আয়োজনে পরবে বলে। মুনিয়া সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ উপন্যাসে পড়েছে– ভালোবাসা হলো বেনারসি শাড়ির মতো ন্যাপথলিন দিয়ে যত্ন করে আলমারিতে তুলে রাখতে হয়। মুনিয়ার মতো এখনকার অনেক নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। এখনকার বললে ভুল হবে, শাড়ি সব সময়ের নারীদের কাছেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। তিন হাজার বছরের পুরোনো এই পোশাকের সঙ্গে নারীর আবেগ জড়িত। তাই উৎসবের দিনগুলোতে অন্তত একটি শাড়ি নারীর চাই-ই চাই।
এবারের ঈদে টাঙ্গাইল, জামদানি, বেনারসি, মসলিন, সিল্ক, কাতান, টিস্যু কিংবা মণিপুরি– কোন শাড়িটি কিনবেন তা নিশ্চয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে? কেনার আগে কোন ব্র্যান্ড কোন ধরনের শাড়ি নিয়ে এসেছে, তা জেনে নেওয়া ভালো। এতে মার্কেটে গিয়ে জলের মতো ঘুরতে হবে না। শাড়ি কেনায় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হবে না।
এবারের ঈদ আয়োজন সামনে রেখে দেশীয় পোশাকের ব্র্যান্ডগুলো নিয়ে এসেছে নতুন শাড়ির সংগ্রহ। গরম, বৈশাখ ও ঈদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন নকশার শাড়ি এনেছে বিভিন্ন ব্র্যান্ড। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে ব্লক, এমব্রয়ডারি, মিরর ওয়ার্ক করে নতুনত্ব আনা হয়েছে রঙ বাংলাদেশের শাড়িতে। পোশাকের ব্র্যান্ড অঞ্জন’স নিয়ে এসেছে রাজশাহী বলাকা সিল্ক, মসলিন, হাফ সিল্ক, কটন সিল্ক, লিনেন কটন, টাঙ্গাইল কটন ও ভয়েল কাপড়ের শাড়ি। সেসব শাড়িতে ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, এমব্রয়ডারি ও কারচুপি করা হয়েছে। ঈদ সামনে রেখে কে-ক্র্যাফটের শাড়ির বৈচিত্র্যপূর্ণ ডিজাইনের একটি বড় আয়োজন থাকছে। নিজস্ব ডিজাইনে মোটিফের ব্যবহার, কালার কম্বিনেশন এবং ভ্যালু অ্যাডিশনে নানা মিডিয়ার ব্যবহার সবার দৃষ্টি কাড়বে।
মোটিফে মাত : কে-ক্র্যাফটের শাড়িতে মোগল আর্ট, মানডালা, টামজারা, ফ্লোরাল, জামদানি, কাঁথা স্টিচ, ট্র্যাডিশনাল, ওরিয়েন্টাল, জিওমেট্রিকসহ মিক্সড মোটিফের উপস্থাপনা ও নানা মিডিয়ার ব্যবহারে আছে।
দিনে-রাতে যেমন শাড়ি : কে-ক্র্যাফটের কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান জানান, ঈদে দিনের বেলায় স্বস্তি সুতি শাড়ি অথবা তাঁতের সুতি শাড়ি বেছে নেওয়া যেতে পারে। রাতে সিল্ক, হাফ সিল্ক, খাদি মসলিন কিংবা মসলিন প্রাধান্য পেতে পারে। নোরা, পিচ, পিঙ্ক, পার্পল, ব্রিক রেড, লেমন গ্রিন, উডেন ব্রাউন, স্কাই, অলিভ, নেভি, ব্ল্যাক, ফিরোজা, কোরা, অ্যাকুয়া, এনটিক, হোয়াইট, প্যাস্টেল, ভায়োলেট, ব্রাউন, কপার, ল্যাভেন্ডার, ম্যাজেন্টা, কোরাল রেড, মেরি গোল্ডসহ পছন্দের রঙের শাড়ি বেছে নিতে পারেন ব্র্যান্ডটি থেকে।
থিমে নতুনত্ব : প্রতিবারের মতো এবারও থিমনির্ভর শাড়ির পসরা নিয়ে এসেছে রঙ বাংলাদেশ। এ বছরের মূল থিম ক্লাসিক্যাল ফোর এলিমেন্টস, অর্থাৎ আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস। এই চার উপাদানের রূপ-বৈচিত্র্যের বিন্যাস ঘটানো হয়েছে এবারের শাড়িতে। এ ছাড়া পাখির রং থিমের কিছু শাড়িও রয়েছে বলে জানান রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক দাস। তিনি জানান, এবারও দুই আঁচলের এক শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে রঙ বাংলাদেশে। এ ধরনের শাড়ি দুই দিক দিয়েই পরা যায়। এতে নতুনত্ব আসে।
পুনর্জীবিত রং, ডিজাইন ও প্যাটার্ন : এই ঈদে গতানুগতিক ধারাকে পাশে সরিয়ে হরীতকীর ফ্যাশনে পুনর্জীবিত হয়েছে নতুন রং, ডিজাইন ও প্যাটার্ন। ঈদের সব ধরনের শাড়ি রঙিন করার চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান হরীতকীর কো-ফাউন্ডার বলরাম পাল। ঈদের জন্য থিমভিত্তিক ডিজাইনে নন ফিগারেটিভ শাড়ি এনেছে। বৈশাখের জন্যও এনেছে দেশীয় ফিগারেটিভ ডিজাইনের নানান সংগ্রহ।
পোশাকের অনলাইন ব্র্যান্ড ‘সরলা’ আরামের কথা চিন্তা করে পোশাক তৈরি করে। এবারের ঈদের শাড়িতে ফ্লোরাল মোটিফ থেকে ঐতিহ্যবাহী ফোক আর্ট কোনো কিছু বাদ পড়েনি। সরলার কর্ণধার মানসুরা স্পৃহা বলেন, প্রতিটি সিজনে আমরা নতুন নতুন থিম নিয়ে কাজ করি। এবারও এর ব্যত্যয় হয়নি। সরলাতে এবারে প্রথম যে বিষয়টি মাথায় রাখা হয়েছে, তা হলো শাড়ির রং। বৈশাখ ও ঈদ দুই-ই খুব জমকালো ও রঙিন। তাই নানান রঙের চর্চা হয়েছে এবারের ডিজাইনে। শাড়িতে ফোক ও জামদানি মোটিফের বহুবিধ নকশা চোখে পড়বে সরলায়।
বাটিক ও সুতার কাজের শাড়ি : বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবার টাই-ডাই, মোম বাটিক ও সুতার কাজের শাড়ি আনা হয়েছে। গরমের কথা মাথায় রেখে এবারের ঈদের শাড়িতে হালকা ফেব্রিক ব্যবহার করা হয়েছে। অনলাইন ব্র্যান্ড ‘জাদুর বাক্স’ ঈদ উপলক্ষে সেমি-মসলিন, হাফ সিল্ক, অরগাঞ্জা, এন্ডি কটন, হ্যান্ডলুম সুতি কাপড়ের শাড়ি নিয়ে এসেছে। উদ্যোগটির কর্ণধার মেহবুব কামাল জাদু বলেন, ‘এই ঈদে আমরা সুতার কাজ এবং টাই-ডাই দুই ধরনের শাড়ি বেশি করেছি। সুতার কাজের শাড়িগুলোতে যশোরের প্রসিদ্ধ যশোর স্টিচ সেলাইয়ের মাধ্যমে অলংকরণ করেছি।’
গরমে আরামের কথা মাথায় রেখে ‘জাদুর বাক্স’-এ কয়েক ধরনের কাপড়ে টাই-ডাই করা হয়েছে। হাফ সিল্ক শাড়িতে টাই-ডাই করে তার ওপর সুতার কাজ করা হয়েছে। হ্যান্ডলুমের পাতলা কটন শাড়ি এবং এন্ডি কটন শাড়িতে প্লেন টাই-ডাই করা হয়েছে। কিছু হাফ সিল্ক শাড়িতে টাই-ডাই করে তার সঙ্গে এমব্রয়ডারি, ব্লক প্রিন্ট, ডলারের কাজ করা হয়েছে। এ ছাড়া হরীতকীর শাড়িতে মোম বাটিক, ডিজিটাল প্রিন্ট ও মোম রঙে আঁকা রংবেরঙের ফুল প্রাধান্য পেয়েছে।
এমব্রয়ডারি-মিরর ওয়ার্কের কারুকাজ : আড়ং, লা রিভ, সোনিয়া মুসা ঢাকা, কে-ক্র্যাফট, অঞ্জন’স, রঙ বাংলাদেশের বিভিন্ন শোরুম ঘুরে এবং ঈদ আয়োজনে দেখা গেছে শাড়িতে আগের চেয়েও এবার বেশি এমব্রয়ডারি, মিরর ও ডলার ওয়ার্ক প্রাধান্য পেয়েছে। স্ক্রিনপ্রিন্ট ও ডিজিটাল প্রিন্ট করা শাড়িতেও রয়েছে হাতের কাজের ছোঁয়া। জর্জেটের শাড়িতে ডিজিটাল প্রিন্টের ছাপ বেশি হলেও কারচুপি, চুমকির কাজও রয়েছে।
ড্র্যাপিং স্টাইলের শাড়ি : এখন ট্রেন্ডমার্ট ও কিছু অনলাইন প্রতিষ্ঠান ড্র্যাপিং স্টাইলের শাড়ি নিয়ে এসেছে। এসব শাড়ি পরতে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। শুধু পরে নিলেই হয়ে যায়। এ ধরনের শাড়ি ২ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকার মধ্যে কেনা যাবে।
জমকালো ব্লাউজ : ব্লাউজ নির্বাচন করতে হবে শাড়ির সঙ্গে মিল রেখে। যেসব শাড়িতে ব্লাউজ পিস থাকে, তা দিয়ে ব্লাউজ বানিয়ে নিন। এখন স্লিভলেস, ব্যাকলেস ব্লাউজ যেমন চলছে তেমনি ম্যাগি, কলস, ঘটি, ফ্লেয়ার, র্যাফেল, বেল স্লিভ ইত্যাদি হাতার ব্লাউজ। অনেকে ক্রপ টপ, টপস ও শার্টের সঙ্গেও পরেন শাড়ি। অফ শোল্ডার, হাই নেক, হল্টার নেক, বোট নেক ব্লাউজ এ বছরও জনপ্রিয়। জারদৌসি কাজের ব্লাউজ, সিঙ্গেল শোল্ডার, প্রিন্সেস কাটসহ নানা কাটের ব্লাউজ মার্কেট থেকে রেডিমেড কিনতে পারবেন। অনলাইন পেজ বর্ণন লাইফস্টাইল, হরীতকী, কালার ক্রেজ, খাঁচা, সাতকাহনসহ বিভিন্ন পেজ থেকে অর্ডার দিয়ে ব্লাউজ কেনা যাবে।
প্রাপ্তিস্থান: এবারের ঈদের শাড়ি কিনতে ঢুঁ মারতে পারেন বিশ্বরঙ, অঞ্জন’স, কে ক্র্যাফট, রঙ বাংলাদেশ, লা রিভ, দেশাল, নিপুণ, বিবিআনা, বাংলার মেলা, সাতকাহনসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডে। প্রতিটি ফ্যাশন ব্র্যান্ড তাদের নিজস্বতার ছাঁপ রেখেছে এবারের ঈদের শাড়িতে। এছাড়া অনলাইন পেইজ সরলা, যাদুর বাক্স, খাদি বাই নুভিয়া, খাঁচা, খুঁত, হরিতকী, অপরাজিতা থেকে কেনা যাবে ঈদের শাড়ি। দেশজ ঐতিহ্যের এক্সক্লুসিভ শাড়ি পেয়ে যাবেন সোনিয়া বাই মুসাতে।
দরদাম: বিশ্বরঙ থেকে ঈদের শাড়ি কেনা যাবে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে। ঈদ উপলক্ষ্যে বিশ্বরঙ নিয়ে এসেছে একটি এক্সক্লুসিভ শাড়ি, যার দাম ১৫ হাজার টাকা। অঞ্জন’স থেকে কটন শাড়ি কেনা যাবে ১ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ২৫০ টাকায়। কটন সিল্ক শাড়ির মূল্য ৩ হাজার থেকে ৮ হাজার ৫০০ টাকা, মসলিন ও জামদানি শাড়ির মূল্য ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৩০ হাজার টাকা, সিল্ক শাড়ির মূল্য ৮ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা এবং কাতান শাড়ির মূল্য ১ হাজার ৫০০ থেকে ৮ হাজার টাকা।
কে ক্র্যাফট থেকে ঈদের শাড়ি কেনা যাবে ১ হাজার থেকে ১১ হাজার টাকার মধ্যে। শাড়ির অলংকরণ, কারুকাজ ও ফেব্রিকের ধরনের ওপর দাম কম বা বেশি হয়। রঙ বাংলাদেশ থেকে শাড়ি কেনা যাবে ১ হাজার ৭৫০ থেকে ১০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে ২ হাজার থেকে ৫ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যেই ক্রেতারা সাধ্যের মধ্যে পছন্দের শাড়ি কিনতে পারবেন। ব্র্যান্ডটিতে এক্সক্লুসিভ শাড়িও আছে। সেসব শাড়ির দাম ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজারর মধ্যে। এছাড়া অনলাইনের বিভিন্ন পেইজ থেকে শাড়ি কেনা যাবে ১ হাজার থেকে শুরু করে ৬ হাজার টাকার মধ্যে।
